॥ মঈনুল আলম ॥
বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশদূষণ যেসব দেশের অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। এ পরিপ্রেেিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনির মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কী রকম সাহায্য-সহায়তা পেতে পারে, তা জানার জন্য পর্যবেক মহল সাগ্রহে অপোয় রয়েছে।
বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশদূষণ বিশ্বের প্রায় সব দেশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং বিভিন্ন দেশ এর প্রতিরোধে যখন বিভিন্ন পদপে নিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার কার্যক্রমের তালিকায় বিষয়টিকে সর্বনিম্ন গুরুত্বের স্থানে নামিয়ে দিয়েছে!
বিশ্ব আবহাওয়া উষ্ণতা পর্যবেক মহলের আশঙ্কা, আগামী দুই দশকে বিশ্ববায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রজলের উচ্চতা যদি দেড় ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়, বাংলাদেশের দণিাঞ্চলে সুন্দরবন এলাকাসহ বিস্তৃত ভূখণ্ড সাগরপ্লাবিত হতে পারে এবং মেঘনা নদীর পানিতে লবণাক্ততা চাঁদপুরের ওপরে চলে যেতে পারে। এটা হলে বাংলাদেশের ব্যাপক এলাকায় সুপেয় পানির অভাব ঘটতে পারে। সাম্প্রতিককালে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবহাওয়া পরিবর্তনে উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ব্যাপক তির সম্মুখীন হচ্ছে তা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত হারে কার্বন ট্যাক্স প্রদানের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
লন্ডনভিত্তিক এইচএসবিসি ব্যাংকের উদ্যোগে প্রণীত বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ কার্যক্রমগুলোর ওপর এক জরিপে বলা হয়েছে, ‘আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধে বিশ্বপ্রচেষ্টার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমরূপে দাঁড়িয়েছে।’
অথচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের আবহাওয়া সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ওবামা জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব একটি নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।’ এর আড়াই বছর পরে যুক্তরাষ্ট্র এখন আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় এক ‘অজ্ঞেয়বাদী’(অ্যাগ্নস্টিক) রূপে আবির্ভূত হয়েছে!
গত অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি পরিষদ আবহাওয়া দূষণ প্রতিরোধে কার্বন ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব পাস করে যা সিনেটে অনুমোদনের মাধ্যমে আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইউরোপে কার্বনদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে কোটা বিনিময়ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে তা প্রতি বছর সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। ভারত জ্বালানি রূপে কয়লার ব্যবহার যা অত্যধিক বায়ুদূষণ করে, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্বন ট্যাক্স আরোপ করছে। চীন তার সাম্প্রতিকতম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পরিবেশ-দূষণকারীদের ওপর অতিরিক্ত পরিবেশদূষণের জন্য চার্জ আরোপ করার নিয়ম প্রবর্তন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গত অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ওবামার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিশ্ব আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে হেসে উড়িয়ে দেয়ার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন বলেন, ‘আমার মনে হয়, ব্যাপারটি আমাদের সঙের চেহারায় দেখাচ্ছে, নয় কি?’
প্রেসিডেন্ট ওবামাও সুর বদলিয়েছেন। তিনি এখন ‘গ্রিন জব্স’ (সবুজ কর্মসংস্থান) স্লোগান উঠিয়েছেন বিশ্বের কল্যাণের জন্য পদপে রূপে নয়, তার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধনের স্বার্থে। এর পাশাপাশি, ইউরোপ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ানোর জন্য বিমান কোম্পানিগুলোর ওপর যে ট্যাক্স আরোপ করেছে, মার্কিন বিমান কোম্পানিগুলোকে তা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য ওবামা প্রশাসন চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে; কানাডা থেকে ৩২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করে তার মাধ্যমে কানাডায় অয়েলস্যান্ড খনিজ থেকে তেল আহরণ করে যুক্তরাষ্ট্রে চালান করার যে প্রকল্প ওবামা প্রশাসন অনুমোদন করেছে, তাতে বাতাসে ব্যাপক হারে দূষণ সঞ্চারিত হবে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রতিবেদক এলিজাবেথ রোজেনথল লিখেছেন, ‘মার্কিনিরা মাথাপিছু ইউরোপীয়দের দ্বিগুণ পরিমাণে বাতাসে কার্বন দূষণ করে। এ কারণে পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ ব্যাপারে মার্কিনিদের এক সহজাত অনীহা রয়েছে। মার্কিনিরা বড় বড় গাড়ি চালাতে এবং বড় বড় বাড়িতে থাকতে ভালোবাসে, যে গুলোতে কার্বনদূষণ অনেক বেশি। তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে বেশি মূল্য দেয় এবং এ কারণে ‘গ্রিন হাউজ গ্যাস’ নির্গমন (বাতাসে কার্বনদূষণ) নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ব্যাপক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আস্থাশীল নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ‘পিউ’ রিসার্চ গ্রুপের এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে ৭৯ শতাংশ মার্কিনি বিশ্বাস করত যে বিশ্বের আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে উঠছে। এখন সেই হার কমে ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে! অন্যতম গবেষক প্রফেসর হফম্যান বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধ প্রসঙ্গটি আমাদের (আমেরিকানদের) সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের প্রতি আদর্শগত চ্যালেঞ্জ প্রকাশ করে।’ যুক্তরাষ্ট্রের সুবৃহৎ খনিজ জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোও আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধ ব্যাপারে শক্তিশালী বিরোধী মহল রূপে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি বিশ্ব আবহাওয়া উষ্ণায়ন ব্যাপারটি অবিশ্বাস করাকে তাদের নির্বাচন প্রচারণায় অন্যতম মুখ্য স্লোগানে পরিণত করেছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টারা অবশ্য বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তন ও বিশ^ আবহাওয়া উষ্ণায়ন প্রতিরোধে প্রশাসন সঙ্কল্পবদ্ধ। কিন্তু পর্যবেক্ষকেরা বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা বস্তুত এ ব্যাপারে যে নিস্পৃহ হয়ে গেছেন তা প্রকাশ পেয়েছে গত ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট ওবামা আবহাওয়া পরিবর্তন সম্পর্কে কোনো উল্লেখই করেননি, যদিও তার আগের বছর পর্যন্ত তা প্রধান কার্যক্রমগুলোর অন্যতম রূপে উল্লেখিত হয়েছিল।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন