মুহাম্মদ রুহুল আমীন
ইরানের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য দেশগুলো ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে আগামী ২৩ মে বাগদাদে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। মধ্য এপ্রিলের ইস্তাম্বুল বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসন্ন বাগদাদ সম্মেলন ব্যর্থ হলে উপসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা পৃথিবীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান শান্তিপূর্ণ জাতীয় নীতির আওতায় বিদ্যুত্ উত্পাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তার বহুল আলোচিত পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নেয়। নতুন এ কর্মসূচি গ্রহণ করার অব্যবহিত পর ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যে অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বৈরী-সম্পর্কের অধিকারী ইসরাইল আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা প্রকাশ করে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদী ইউরোপ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য সব ধরনের উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে।
পরমাণু ইস্যুতে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনের নিমিত্তে ইরান বারবারই জাতিসংঘসহ বিশ্ব ফোরামগুলো এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক পর্যায়ে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উপস্থাপন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানের বক্তব্যে কোনোভাবে স্বীয় অবস্থান পরিবর্তন না করে আগের তুলনায় আরও কঠোরভাবে ওই ইস্যু মোকাবিলার চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো মূলত ৫ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। এক. যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের চিরমিত্র ইসরাইলকে দিয়ে ইরানের প্রতি যুদ্ধহুমকিসহ বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করা। দুই. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করা। তিন. ইরানের অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্য বিনাশের চেষ্টা করা। চার. ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও পারমাণবিক স্থাপনায় গোপন হামলা পরিচালনা করা। পাঁচ. ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সত্তর দশকের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নতুন জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং তার মধ্যপ্রাচ্যের অনুচররা সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আশির দশকে ভ্রাতৃপ্রতিম ইরাককে ক্ষেপিয়ে দেয়া হয় ইরানের বিরুদ্ধে এবং প্রায় এক দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধে নতুন মতাদর্শের এ দেশটি প্রায় শ্মশান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ইরানকে মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও কালো তালিকাভুক্ত করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এক ঘরে করার কৌশল অবলম্বন করা হয়।
স্বীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ইরানের ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অতিসতর্কতার সঙ্গে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রসহ উন্নত পুঁজিবাদী ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যত্র তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আস্তে আস্তে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় এলাকার সুস্থ রাজনৈতিক এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতির এক নিয়ত সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে ইরান বিশ্ব মানচিত্রে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
বিভিন্নভাবে দমন করায় কৌশলে ব্যর্থতার পর পাশ্চাত্য ও তার বন্ধুরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরানকে পর্যুদস্ত করার অপর এক কৌশল অবলম্বন করে। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে জাতিসংঘের পারমাণবিক কুত্তাপাহারা (nuclear watchdog) নামক আইএইএ সংস্থার মাধ্যমে কয়েকবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করা হয় এবং প্রতিবারই আইএইএ হাস্যকর ও ভয়ঙ্কর পারমাণবিক প্রতিচ্ছবি প্রদান করে।
এ পর্যন্ত কয়েক দফায় জাতিসংঘ ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে এবং ঘোষিত পারমাণবিক পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বিশ্ব সংস্থার সফল কূট-কৌশল প্রয়োগ করা হয়। জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও কয়েকবার বাণিজ্য অবরোধ এবং মুদ্রা অবরোধ ও ব্যাংক অবরোধের মতো সংবেদনশীল নিষেধাজ্ঞার নির্লজ্জ কৌশল গ্রহণ করে। ইইউ রাষ্ট্রগুলো ইরানী তেল ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ ইরানের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিরোধের ঘূর্ণায়মান বলয় গড়ে তোলে, যাতে ইরান কাঠামোগত আন্তঃঅবরোধের (structural interlockimg) যাঁতাকলে পিষ্ট হয়।
জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ দেশগুলোও ইরানের ওপর ব্যাংক অবরোধ এবং তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানকে অচল করে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য বিশ্বের ইরান-বিরোধী এসব পদক্ষেপ ইরানকে বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেললেও পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য এখনও যে অবাস্তবায়িত রয়েছে তা স্পষ্ট।
পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মুখে ইরান সম্ভবত কালক্ষেপণ করার কৌশল বেছে নিয়েছে। সময় সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক—এ গুরুবাক্যটি হয়তো ইরানিরা প্রয়োগ করছে সর্বাংশে। ইরানের সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজি হলো, পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখা। এ পর্যন্ত লক্ষ্য করা গেছে, সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ইরান সরকার, ইরানের রিভলুশনারি গার্ড, স্বেচ্ছাসেবক সৈনিক, ইরানি জনগণ সবাই পারমাণবিক ইস্যুতে নজিরবিহীনভাবে ঐক্য গড়ে তুলেছে, যাতে ফাটল ধরানো সম্ভব হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইরানের দ্বিতীয় কৌশল হলো—ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানির বিকল্প বের করা এবং এরই মধ্যে চীন ও তুরস্কের মাধ্যমে ইরান তার এ কৌশল বাস্তবায়নে বেশ সফল হচ্ছে। ইরানের আরেকটি কৌশল হলো—যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং ইরানের ব্যবসায়ী পার্টনার রাষ্ট্রগুলোকে ইরানি তেল ক্রয়ে অনড় অবস্থানে রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্র ভারত এরই মধ্যে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ইরান থেকে তেল ক্রয় কোনোভাবে বন্ধ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এশীয় মিত্র জাপানও সুনির্দিষ্টভাবে তেল ক্রয় হ্রাস করার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু জানায়নি।
এ পর্যন্ত সংঘটিত সব ঘটনার বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট, ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের আরোপিত কোনো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না। এমনি প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাগদাদ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ছয়টি পরাশক্তিধর রাষ্ট্র এবং তাদের শত প্রশ্ন, কৌশল ও আক্রমণের মুখে সম্মেলনে আসছে পারমাণবিক কর্মসূচির ধারক উপসাগরীয় ইরান।
বাগদাদ বৈঠকের সফলতার কতকগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। প্রথমত, ইরান ও পাশ্চাত্যের দাবির যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সম-অধিকারের নীতির নিক্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশ্চাত্যের দাবি হলো—ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিতে ২০ শতাংশ স্থিতি ফিরিয়ে আনুক। এর পাল্টা দাবি উত্থাপন করেছে ইরান। তাদের শর্ত হলো—তেল রফতানি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পুরনো ও নতুন আরোপিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। ইরানের এ দাবি কতটুকু, কী মাত্রায় এবং কীভাবে পাশ্চাত্যপক্ষ মূল্যায়ন করবে তার ওপর নির্ভর করবে বাগদাদ বৈঠকের সাফল্য-ব্যর্থতা।
দ্বিতীয়ত, এর আগে অনুষ্ঠিত সব বৈঠকে ইরান একই দাবি বারবার জানিয়ে এসেছে। একবিন্দুও ইরান তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। অন্যদিকে পাশ্চাত্যও একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে আসছে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতরভাবে। এভাবে এক অচলাবস্থা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে এ ইস্যুকে ঘিরে।
এ অবস্থায় দু’পক্ষকেই তার অনড় অবস্থা থেকে একটু সরে এসে ‘জয় জয় কৌশল’ (win-win strategy) অবলম্বন করলে আসন্ন বাগদাদ সম্মেলনে সফল হতে পারে।
তৃতীয়ত, আইএইএ জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিষ্ঠান, যার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রগুলোর পারমাণবিক অস্ত্রায়ন পর্যবেক্ষণ করা। এই প্রতিষ্ঠানের রীতি-নীতিতে একটা রাষ্ট্র কী ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে তার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আইএইএ’র বিধি-বিধান পর্যালোচনাপূর্বক ইরানের দাবির যথার্থতা পরীক্ষা করা।
চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিরক্ষায় শুধু একতরফা অস্ত্রায়ন নিরোধ গ্রহণযোগ্য সমাধান বয়ে আনতে পারে না। ইরানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইলকে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রেখে ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার দ্বৈতনীতি ফলপ্রসূ হতে পারে না।
পঞ্চমত, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিসাম্য বজায় রেখে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ইসরাইল ও ইরান উভয়ের পারমাণবিক অস্ত্রায়নের পথ থেকে নিবৃত করার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালনই কেবল আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখতে কার্যকর হতে পারে।
বাগদাদ বৈঠকের সাফল্যের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শান্তি নির্ভর করছে। সে কারণে ওই বৈঠকের সফলতার পূর্বশর্তগুলো বিবেচনায় রেখে পঞ্চ বৃহত্শক্তি রাষ্ট্রগুলোর এর আগের ইস্তাম্বুল বৈঠকের অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবমুখী নীতি অনুসরণে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। ইস্তাম্বুল বৈঠকে ইরানের কঠোর অবস্থান এবং পাশ্চাত্যের হুমকি-ধমকি যেমন কোনো সমাধান বয়ে আনেনি, তেমনি অবিবেচনামূলক, অবিচারমূলক, অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং একপেশে পাশ্চাত্য দ্বৈতনীতি বাগদাদ সম্মেলনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, সিআইডিএস
mramin68@yahoo.com
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান শান্তিপূর্ণ জাতীয় নীতির আওতায় বিদ্যুত্ উত্পাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তার বহুল আলোচিত পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নেয়। নতুন এ কর্মসূচি গ্রহণ করার অব্যবহিত পর ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যে অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বৈরী-সম্পর্কের অধিকারী ইসরাইল আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা প্রকাশ করে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদী ইউরোপ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য সব ধরনের উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে।
পরমাণু ইস্যুতে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনের নিমিত্তে ইরান বারবারই জাতিসংঘসহ বিশ্ব ফোরামগুলো এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক পর্যায়ে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উপস্থাপন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানের বক্তব্যে কোনোভাবে স্বীয় অবস্থান পরিবর্তন না করে আগের তুলনায় আরও কঠোরভাবে ওই ইস্যু মোকাবিলার চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো মূলত ৫ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। এক. যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের চিরমিত্র ইসরাইলকে দিয়ে ইরানের প্রতি যুদ্ধহুমকিসহ বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করা। দুই. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করা। তিন. ইরানের অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্য বিনাশের চেষ্টা করা। চার. ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও পারমাণবিক স্থাপনায় গোপন হামলা পরিচালনা করা। পাঁচ. ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সত্তর দশকের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নতুন জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং তার মধ্যপ্রাচ্যের অনুচররা সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আশির দশকে ভ্রাতৃপ্রতিম ইরাককে ক্ষেপিয়ে দেয়া হয় ইরানের বিরুদ্ধে এবং প্রায় এক দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধে নতুন মতাদর্শের এ দেশটি প্রায় শ্মশান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ইরানকে মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও কালো তালিকাভুক্ত করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এক ঘরে করার কৌশল অবলম্বন করা হয়।
স্বীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ইরানের ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অতিসতর্কতার সঙ্গে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রসহ উন্নত পুঁজিবাদী ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যত্র তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আস্তে আস্তে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় এলাকার সুস্থ রাজনৈতিক এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতির এক নিয়ত সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে ইরান বিশ্ব মানচিত্রে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
বিভিন্নভাবে দমন করায় কৌশলে ব্যর্থতার পর পাশ্চাত্য ও তার বন্ধুরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরানকে পর্যুদস্ত করার অপর এক কৌশল অবলম্বন করে। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে জাতিসংঘের পারমাণবিক কুত্তাপাহারা (nuclear watchdog) নামক আইএইএ সংস্থার মাধ্যমে কয়েকবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করা হয় এবং প্রতিবারই আইএইএ হাস্যকর ও ভয়ঙ্কর পারমাণবিক প্রতিচ্ছবি প্রদান করে।
এ পর্যন্ত কয়েক দফায় জাতিসংঘ ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে এবং ঘোষিত পারমাণবিক পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বিশ্ব সংস্থার সফল কূট-কৌশল প্রয়োগ করা হয়। জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও কয়েকবার বাণিজ্য অবরোধ এবং মুদ্রা অবরোধ ও ব্যাংক অবরোধের মতো সংবেদনশীল নিষেধাজ্ঞার নির্লজ্জ কৌশল গ্রহণ করে। ইইউ রাষ্ট্রগুলো ইরানী তেল ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ ইরানের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিরোধের ঘূর্ণায়মান বলয় গড়ে তোলে, যাতে ইরান কাঠামোগত আন্তঃঅবরোধের (structural interlockimg) যাঁতাকলে পিষ্ট হয়।
জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ দেশগুলোও ইরানের ওপর ব্যাংক অবরোধ এবং তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানকে অচল করে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য বিশ্বের ইরান-বিরোধী এসব পদক্ষেপ ইরানকে বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেললেও পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য এখনও যে অবাস্তবায়িত রয়েছে তা স্পষ্ট।
পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মুখে ইরান সম্ভবত কালক্ষেপণ করার কৌশল বেছে নিয়েছে। সময় সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক—এ গুরুবাক্যটি হয়তো ইরানিরা প্রয়োগ করছে সর্বাংশে। ইরানের সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজি হলো, পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখা। এ পর্যন্ত লক্ষ্য করা গেছে, সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ইরান সরকার, ইরানের রিভলুশনারি গার্ড, স্বেচ্ছাসেবক সৈনিক, ইরানি জনগণ সবাই পারমাণবিক ইস্যুতে নজিরবিহীনভাবে ঐক্য গড়ে তুলেছে, যাতে ফাটল ধরানো সম্ভব হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইরানের দ্বিতীয় কৌশল হলো—ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানির বিকল্প বের করা এবং এরই মধ্যে চীন ও তুরস্কের মাধ্যমে ইরান তার এ কৌশল বাস্তবায়নে বেশ সফল হচ্ছে। ইরানের আরেকটি কৌশল হলো—যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং ইরানের ব্যবসায়ী পার্টনার রাষ্ট্রগুলোকে ইরানি তেল ক্রয়ে অনড় অবস্থানে রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্র ভারত এরই মধ্যে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ইরান থেকে তেল ক্রয় কোনোভাবে বন্ধ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এশীয় মিত্র জাপানও সুনির্দিষ্টভাবে তেল ক্রয় হ্রাস করার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু জানায়নি।
এ পর্যন্ত সংঘটিত সব ঘটনার বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট, ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের আরোপিত কোনো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না। এমনি প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাগদাদ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ছয়টি পরাশক্তিধর রাষ্ট্র এবং তাদের শত প্রশ্ন, কৌশল ও আক্রমণের মুখে সম্মেলনে আসছে পারমাণবিক কর্মসূচির ধারক উপসাগরীয় ইরান।
বাগদাদ বৈঠকের সফলতার কতকগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। প্রথমত, ইরান ও পাশ্চাত্যের দাবির যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সম-অধিকারের নীতির নিক্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশ্চাত্যের দাবি হলো—ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিতে ২০ শতাংশ স্থিতি ফিরিয়ে আনুক। এর পাল্টা দাবি উত্থাপন করেছে ইরান। তাদের শর্ত হলো—তেল রফতানি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পুরনো ও নতুন আরোপিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। ইরানের এ দাবি কতটুকু, কী মাত্রায় এবং কীভাবে পাশ্চাত্যপক্ষ মূল্যায়ন করবে তার ওপর নির্ভর করবে বাগদাদ বৈঠকের সাফল্য-ব্যর্থতা।
দ্বিতীয়ত, এর আগে অনুষ্ঠিত সব বৈঠকে ইরান একই দাবি বারবার জানিয়ে এসেছে। একবিন্দুও ইরান তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। অন্যদিকে পাশ্চাত্যও একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে আসছে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতরভাবে। এভাবে এক অচলাবস্থা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে এ ইস্যুকে ঘিরে।
এ অবস্থায় দু’পক্ষকেই তার অনড় অবস্থা থেকে একটু সরে এসে ‘জয় জয় কৌশল’ (win-win strategy) অবলম্বন করলে আসন্ন বাগদাদ সম্মেলনে সফল হতে পারে।
তৃতীয়ত, আইএইএ জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিষ্ঠান, যার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রগুলোর পারমাণবিক অস্ত্রায়ন পর্যবেক্ষণ করা। এই প্রতিষ্ঠানের রীতি-নীতিতে একটা রাষ্ট্র কী ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে তার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আইএইএ’র বিধি-বিধান পর্যালোচনাপূর্বক ইরানের দাবির যথার্থতা পরীক্ষা করা।
চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিরক্ষায় শুধু একতরফা অস্ত্রায়ন নিরোধ গ্রহণযোগ্য সমাধান বয়ে আনতে পারে না। ইরানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইলকে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রেখে ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার দ্বৈতনীতি ফলপ্রসূ হতে পারে না।
পঞ্চমত, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিসাম্য বজায় রেখে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ইসরাইল ও ইরান উভয়ের পারমাণবিক অস্ত্রায়নের পথ থেকে নিবৃত করার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালনই কেবল আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখতে কার্যকর হতে পারে।
বাগদাদ বৈঠকের সাফল্যের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শান্তি নির্ভর করছে। সে কারণে ওই বৈঠকের সফলতার পূর্বশর্তগুলো বিবেচনায় রেখে পঞ্চ বৃহত্শক্তি রাষ্ট্রগুলোর এর আগের ইস্তাম্বুল বৈঠকের অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবমুখী নীতি অনুসরণে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। ইস্তাম্বুল বৈঠকে ইরানের কঠোর অবস্থান এবং পাশ্চাত্যের হুমকি-ধমকি যেমন কোনো সমাধান বয়ে আনেনি, তেমনি অবিবেচনামূলক, অবিচারমূলক, অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং একপেশে পাশ্চাত্য দ্বৈতনীতি বাগদাদ সম্মেলনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, সিআইডিএস
mramin68@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন