ব দ র“ দ্দী ন উ ম র
যে কথা কফি আনানের অনেক আগেই বলা দরকার বা উচিত ছিল সে কথা তিনি অবশেষে বললেন। কথাটি হল, বাইরের শক্তিগুলোই সিরিয়ায় সহিংসতা ছড়িয়ে দি”েছ (উধরষু ঝঃধৎ ৩০.৬.২০১২)। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার পক্ষে এ কথা বলার অসুবিধা ছিল এবং এখনও আছে। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি যেসব তথ্য জানতেন, সেগুলো কি আজ পর্যন্ত তার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে? সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার জাতিসংঘের সর্বো”চ কর্মকর্তা হিসেবে তাকে যেসব কাজ করতে হতো, তাতে তার বিবেক কি কালিমামুক্ত আছে? এসব কথা এক হিসেবে অবান্তর, কারণ জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদীরা এমন লোককে দেয় না বা দিতে পারে না, যিনি সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে বিশ্বের অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ এবং নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবেন।
লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির শাসন উৎখাত করে সে দেশটিকে পদানত করার পর এখন সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়াকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বেশ খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা ও কার্যকর করছে। এর জন্য তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোকে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করছে। এই গোলাম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন আরব লীগ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় তাদের স্বার্থেই ছিল সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। কিš‘ সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো জাতিসংঘের বেপরোয়া হস্তক্ষেপের পরি¯ি’তি না থাকায় আরব লীগ এখন জাতিসংঘের লেজুড় হিসেবে সরাসরি কাজ করছে। এই কার্য সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ এবং আরব লীগ যৌথভাবে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়ার পরি¯ি’তি সামাল দেয়ার কাজে নিযুক্ত করেছে।
লিবিয়ায় হড় ভষু ুড়হব প্রস্তাবে রাশিয়া ও চীন ভেটো না দেয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে অবাধে সে দেশের ওপর বোমাবর্ষণ করে শুধু বিমানবাহিনী নয়, ¯’লবাহিনীকেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেছিলÑ সেরকম সুযোগ এখনও পর্যন্ত সিরিয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। কারণ লিবিয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ভেটো ব্যবহার না করে রাশিয়া ও চীন যে বোকামি করেছিল, তার খেসারত তারা দিয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটো শক্তিগুলো তাদের তেলসহ সেখানকার কোন কিছুতে ভাগ না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার পর এখন তাদের হুঁশ হয়েছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সিরিয়ায়ও লিবিয়ার মতো হড় ভষু ুড়হব কার্যকর করার চেষ্টা করলেও রাশিয়া ও চীন এখন তার বিরোধী। তা ছাড়া লিবিয়া থেকে সিরিয়া স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে রাশিয়ার কাছে অনেক বেশি গুর“ত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার ব্যাপারে হাত মেলানোতে রাশিয়া ও সেই সঙ্গে চীনের অসুবিধা আছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এই দ্বন্দ্ব সিরিয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এ কারণেই এখনও পর্যন্ত সিরিয়া একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে আছে, যদিও শেষ পর্যন্ত অব¯’া কী দাঁড়াবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
লিবিয়ার মতো সিরিয়ায়ও সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বির“দ্ধেই বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছে। এদিক দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-খ্যাত তিউনিসিয়া ও মিসরের অব¯’া অন্যরকম। এই দুই দেশে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, সিরিয়ার ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই। প্রেসিডেন্ট আসাদ প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাইরের শক্তি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের গ্র“প খাড়া করে তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। প্রথমে ছোট আকারে এটা করলেও এখন খুব বড় ও বিশাল আকারে তারা এটা করছে। এর অন্য একটি দিক হ”েছ, এ কাজ যে তারা করছে এটা গোপন করা এখন তাদের পক্ষে সম্ভব হ”েছ না। শুধু তাই নয়, তারা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গোলাম রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কোন গোপনীয়তার প্রয়োজন বোধ করছে না। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আসাদের বির“দ্ধে যে বিদ্রোহী বাহিনী গঠিত হয়েছে তার সদস্যদের বেতন তারা দেবে! অর্থাৎ এই ‘বিদ্রোহী’ বাহিনীকে তারা আগে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও এখন সেই বাহিনীর সদস্যদের চাকরি রক্ষার দায়িত্বও সৌদি আরব নিয়েছে! তাদের অর্থের কোন অভাব নেই। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে যারা নিয়মিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনা প্র্রয়োজনে সামরিক বিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজসহ সবরকম যুদ্ধ-সরঞ্জাম কেনে, তাদের পক্ষে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী প্রতিপালন এমন কোন বড় ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। এ কাজ যে তারা শুধু নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় অব¯’ান থেকেই করছে তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুকুম অনুযায়ীই এটা হ”েছ।
সিরিয়ায় এখন প্রতিদিনই দুই পক্ষের আক্রমণে মানুষের জীবন যা”েছ। এর মধ্যে যেমন সেনাবাহিনীর লোক আছে, তেমনি আছে নিরীহ লোক, নারী, শিশু, বৃদ্ধÑ সব ধরনের লোক। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে নিয়ে সিএনএন, বিবিসিসহ দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী এবং আশ্রিত ও অনুগত দেশটির টিভি চ্যানেলগুলোতে ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্রে এ খবর এমনভাবে প্রচারিত হ”েছ, যাতে মনে হবে শুধু সরকার পক্ষের আক্রমণেই এভাবে এ পর্যন্ত পনের হাজার লোক সিরিয়ায় নিহত হয়েছে। কিš‘ বাস্তব ঘটনা এই যে, তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর আক্রমণেই এসব হত্যাকাণ্ড বেশি হ”েছ। এর একটা বড় প্রমাণ এই যে, এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হ”েছ সিরীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই। যদি সরকারবিরোধীদের শক্তিশালী আক্রমণ না হতো তাহলে এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা নিহত হতো না। এ কারণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার প্রথম থেকেই বলে আসছেন, যেহেতু সরকারি বাহিনীর ওপর বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্ত তথাকথিত বিদ্রোহী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালা”েছ, কাজেই তাদের প্রতিহত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কফি আনান সিরিয়ার ‘শান্তির দূত’ হিসেবে জাতিসংঘ এবং আরব লীগের দ্বারা নিযুক্ত হওয়ার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট আসাদ তাকে বারবার এ কথা বলেছেন। কিš‘ তিনি এ কথায় বিশেষ কান না দিয়ে প্রায় একতরফাভাবেই আসাদকে এর জন্য দায়ী করে এসেছেন। কিš‘ এখন সিরিয়ায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এত খোলাখুলিভাবে শুর“ হয়েছে যে, কফি আনান এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, সিরিয়ায় বিদেশী শক্তিগুলো সেখানে সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করছে!
সিরিয়ার সীমানা লংঘন করে তুর্কি বিমান ঢুকে পড়লে তাতে দোষ নেই। দোষ হ”েছ সেই অনুপ্রবেশকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করায়! আরব দেশগুলোর বাইরে তুর্কি ন্যাটোর ল্যাংড়া সদস্য হিসেবে এখন সিরিয়াবিরোধিতায় খুব সক্রিয়। তারা বলছে, প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া আক্রমণের কোন ই”ছা তাদের নেই। কিš‘ তা সত্ত্বেও সিরিয়া সীমান্তে তারা বড় আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে। তুর্কির কথায় বিশ্বাসের কারণ যে নেই, এটা বলার দরকার হয় না। কাজেই তুর্কি তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুর“ করার পাল্টা হিসেবে সিরিয়াও এখন তাদের তুর্কি সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। এভাবেই এ অঞ্চল এখন উত্তপ্ত হ”েছ এবং এক যুদ্ধাব¯’া সেখানে তৈরি হ”েছ।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে কফি আনান সিরিয়ায় একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। তবে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অনেক বাইরের শক্তি সিরিয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে জড়িত আছে। তার ছয় দফা ঐক্য প্রস্তাবে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্মতি থাকলেও তাদের মধ্যে এক্ষেত্রে বিভেদ খুব স্পষ্ট। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আসাদ ২৮ জুন ইরানি টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যারা তার সরকারের বির“দ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালা”েছ তাদের নির্মূল করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার সমস্যা সিরিয়াই মোকাবেলা করবে। কোন বাইরের শক্তিকেই এখানে নাক গলাতে দেয়া হবে না। কিš‘ প্রেসিডেন্ট আসাদ যা-ই বলুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরা তো বটেই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অনুগত রাষ্ট্রগুলোকেও তারা এখন সিরিয়ার বির“দ্ধে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে বলা যায় না। তবে সিরিয়া যদি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা ধ্বংস হয়, তাহলে তারপর তাদের দৃষ্টি পড়বে লেবাননের ওপর। সেখানে তারা হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অখণ্ড আধিপত্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর এক পা এগিয়ে যাবে। সিরিয়ায় যেমন, লেবাননেও তেমনি সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুর“ত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যে পর্যন্ত না সৌদি আরবে ‘আরব বসন্তের’ তুফান উঠবে, সে পর্যন্ত এই দেশটি ইসরাইলের মতোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই ভূমিকা পালন করে যাবে।
৩০.৬.২০১২