ড. মো. আব্দুল্লাহ হেল কাফী
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের রাজ্যবিহীন প্রজা বলে পরিচিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কিছু অংশ রয়েছে মায়ানমারে আর কিছু অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমভাগে মূলত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবস্থান। অন্যদিকে বাংলাদেশের শেষ সীমানা হিসাবে পরিচিত হচ্ছে টেকনাফ। আনুমানিক ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সাম্প্রতিককালে টেকনাফে অবস্থান করছে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টিই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী-নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, যারা রাখাইন নামে পরিচিত। ফলে পূর্ব থেকেই এ সকল রাখাইন জনগোষ্ঠীর সাথে মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটা দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। তাছাড়া মায়ানমারের সরকারও এসকল রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মায়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন।
অতি সাম্প্রতিককালে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা এবং রাখাইন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেননা, রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজমান সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের ফলে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার মায়ানমার থেকে আসা এ সকল রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না।
ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে মায়ানমার। সাম্প্রতিককালে মায়ানমারে গণতন্ত্রের যে ধারা শুরু হয়েছে তা উক্ত দাঙ্গার ফলে বিচ্যুত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই থিয়েন সেইন-এর নেতৃত্বে বর্তমান মায়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকার গত ১৩ই জুন রাখাইন প্রদেশে জাতিগত বিদ্বেষ এবং অরাজকতা দূর করার লক্ষ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে।
ধারণা করা যায় মায়ানমারের রাখাইন এবং আরাকান রাজ্যে আনুমানিক ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। যারা মৌলিক অধিকারের দিক হতে শোষণ এবং বিভাজনের স্বীকার। রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বংশানুক্রমে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসতে থাকলেও মায়ানমার সরকার এদেরকে বাংলাদেশ হতে আসা অবৈধ অভিবাসনকারী বলে আখ্যায়িত করে থাকে এবং এ সকল রোহিঙ্গাকে মায়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। গত মে মাসে মায়ানমারের অভিভাসন মন্ত্রী খিন ই মন্তব্য করেন যে, রোহিঙ্গা নামে কোন নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী মায়ানমারে নেই। উগ্র জাতীয়তাবাদী মায়ানমার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী করে দিয়েছে। আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হয় না। তাদের বাঁচা-মরা, বিবাহ ও সন্তানধারণ, কাজ ও ভ্রমণ, লেখাপড়া ও বাণিজ্য -সবই সামরিক শাসকদের কৃপার অধীন। এবারের মতো আরো অজস্রবার তাদের বসতি পুড়েছে। তাদের ওপর জাতিগত শুদ্ধতার গণহত্যা চলেছে।
ধারণা করা হচ্ছে যে, গত মে মাসে মায়ানমারে একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীকে গণধর্ষণ এবং পরে খুন করার পর থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা উক্ত কর্মকাণ্ডের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছিল। আর এরই রেশ ধরে প্রতিশোধপরায়ণ বৌদ্ধরা একটি বাস থেকে দশজন মুসলমানকে ধরে নিয়ে আসে এবং পিটিয়ে মেরে ফেলে। আর এরই সূত্র ধরে গত ৯ই জুন প্রথমে মোঙদাওয়ে এবং পরে সিত্ত্বয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মোঙদাওয়ে এবং সিত্ত্বয়ের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রয়েছে বলে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে চলে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা সরকারের কাছ থেকে কোন ধরনের ইতিবাচক আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত এদেরকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে আনুমানিক ২৫,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। যারা জাতিসংঘের সহায়তায় নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আবার সরকারি সূত্র অনুসারে আনুমানিক ২,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে -ছিটিয়ে আছে। এদের অধিকাংশ ১৯৯২ সালের দিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিল।
এমন অবস্থায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন দাঙ্গার ফলে রাখাইন রাজ্য হতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়। এদিকে জাতিসংঘ এবং এইচ আর ডাব্লিউ এর এরূপ আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি মন্তব্য করেন যে, রোহিঙ্গা জনগণকে আশ্রয় দান করার ব্যাপারে বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক চাপ পরিহার করে এবং মায়ানমারকেই এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো উচিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আনুমানিক ১ কোটি বাংলাদেশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলেও মায়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চাওয়ার ঘটনার থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৬ই জুন রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এ কথা বলেন।
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গায় প্রাণ হারায় বেশকিছু মানুষ। আনুমানিক ১৬,০০০ মুসলমানদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে উক্ত দাঙ্গায়। ফলে বেশকিছু শরণার্থী সীমান্তের নাফ নদী পেরিয়ে উল্টোদিকে বাংলাদেশে পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার ফলে নারী, শিশু ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের নৌকাগুলো এখনো সমুদ্রে ভাসছে। তাদের কাছে খাবার, ঔষধ, পানীয়জল কিছুই নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে জেনেভায় ইউএনএইচসিআর-এর সদর দফতর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একই ধরনের সংঘর্ষের জেরে পালিয়ে আসা বহু শরণার্থীকে আগেও বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছিল এবং এখনো বাংলাদেশে ২৫,০০০-৩০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। ফলে যারা এখন পালিয়ে আসছে তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্যই পালিয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশের উচিত এদেরকে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও আশ্রয় দান করা।
সীমান্তবর্তী নাফ নদী এবং কক্সবাজারের টেকনাফের কাছে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রবেশের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনি বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং কোস্ট গার্ড রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা রুখে দেয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘনের সামিল বলে মনে হতে পারে। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য গত ১২ই জুন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর আবাসিক প্রতিনিধি ক্রেইগ স্যান্ডার্স বিবিসিকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ, তারা যেন সীমান্ত প্রহরা শিথিল রাখে এবং শরণার্থীকে ঢুকতে দেয়, বিশেষ করে যারা সহিংসতায় আহত হয়েছে’।
জাতিসংঘের এরূপ আহ্বানের প্রত্যুত্তরে গত ১২ই জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দীপু মনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক শরণার্থী আছে। অবৈধভাবেও অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব এমনিতেই বেশি। এই অবস্থায় মায়ানমারের শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের ফলে সামাজিক পরিবেশ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর প্রভাব পরতে পারে’।
কিন্তু বর্তমানকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলই সহযোগিতামূলক নিরাপত্তার উপর অধিকমাত্রায় গুরুত্বারোপ করছে। মায়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাই মায়ানমারের অভ্যন্তরে যেকোন ধরনের রাজনৈতিক এবং জাতিগত সমস্যাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের উচিত সাময়িকভাবে হলেও এসকল রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয়দান করা এবং উক্ত দাঙ্গা কিভাবে সমাধান করা যায় সে ব্যাপারে মায়ানমারের সাথে আলোচনায় বসা।
আবার যেহেতু, রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মনোযোগে এসেছে, একাত্তরের ভারতের মতো শরণার্থী সমস্যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ মায়ানমারে শান্তি কায়েমে ভূমিকা রাখতে পারে। মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত, সমুদ্রসীমাসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। সেসব সমস্যা সমাধানের চাপ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া কৌশলগত চাল হিসেবে খারাপ হয় না। জাতিসংঘ ও আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। মায়ানমারে যতদিন অশান্তি থাকবে ততদিন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে।
তাছাড়া জাতিসংঘের এরূপ আহ্বানের পরও যদি বাংলাদেশ সরকার পালিয়ে আসা এ সকল রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে না পারে তাহলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাই আপাতত বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানবিক দৃষ্টিকোণ্ থেকে হলেও এসকল রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া এবং পরে রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা হলে তখন নিজ জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করা। অর্থাত্ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরকে কিভাবে মায়ানমারে ফিরিয়ে দেয়া যায় সে ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের সাথে আলোচনায় বসা।
n লেখক:শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Email: kafi.juniv@yahoo.com
good newsMy Site
উত্তরমুছুন